এক যে ছিল রাজকন্যা। চাঁদের কণার মত দেখতে। অসম্ভব সুন্দরী! রাজকন্যা এত সুন্দরী হলে কী হবে, তার বেজায় দেমাগি। রাজা তাঁর জন্য নানা জাতের ফুল ও বাহারি ফলের বাগান করে রেখেছেন। বাগানে তারার মত ফুটে থাকে ফুল। ফলের ভারে নুয়ে পড়া গাছে অজস্র পাখির কিচিরমিচির শব্দ। আর বাগানের ঠিক মাঝখানে আছে একটা পুকুর। সোনার হাতল, রূপোর সিঁড়ি, পিতলের নকশাকাটা পুকুরঘাট। পুকুরে নানা রঙের মাছ আর রাজহাঁসের আনন্দ-ছুটোছুটি। দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়।রাজকন্যা প্রতিদিন বাগানে এসে ঘুরে বেড়ায়। সে ফুল-পাখি ও ফলের সাথে কথা বলে। তারপর পুকুরঘাটে বসে কথা বলে রঙ্গিন মাছ ও হাঁসদের সঙ্গে।
কী কথা বলে রাজকন্যা?
রাজকন্যা যা বলে এর সবটুকুই তার রূপের অহংকার। সে ফুলকে বলে, আমার রূপের সাথে তোমাদের রূপের কি কোনো তুলনা হয়? আমি হলাম সৌন্দর্যের দেবী। আমি বাগানে এলে তোমাদের দিকে আর কেউ ফিরেও তাকায় না।
তোমরা প্রতিদিন তোমাদের পাঁপড়ি বিছিয়ে দিয়ে আমার পথ করে দেবে। আমি তোমাদের নরম পাঁপড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে যাব। আর আমার পায়ের স্পর্শে তোমরা আরও সুন্দর হয়ে উঠবে। তোমাদের জীবন হবে ধন্য। রাজকন্যা বাগানের ফলকে, গাছকে আর পাখিকেও এসব বলে। সে ছুটোছুটি করে চলে যায় পুকুরঘাটে। সিঁড়ি বেয়ে একদম পানির কাছে গিয়ে বসে রাজকন্যা। সে টলটলে পানিতে দেখতে পায় নিজেকে। তার রূপে সে নিজেই মুগ্ধ হয়ে হাঁস আর মাছকে বলে, তোমাদের গায়ে যত বাহারি পালক আর রঙ-ই থাকুক না কেন, তোমরা কি কোনোদিন আমার মত এত সুন্দর হতে পারবে? কখ্খনো না!
আমি তোমাদের সঙ্গে কথা বলি বলে মনে কোরো না, তোমরা আমার কাছাকাছি কিছু হয়ে গেছ। তোমাদের থেকে ওই সূর্যটার যত ব্যবধান, আমার থেকে তোমাদের তত ব্যবধান। আমি যখন আবার এ পুকুরঘাটে আসব, পুকুরের জল ঢেউ তুলে আমাকে গোসল করিয়ে দেবে। তোমরা সারাজীবন গর্ব করে বলতে পারবে, আমাদের স্পর্শ করে হেঁটে গেছে এমন এক রূপসী রাজকন্যা, যার রূপের কোনো তুলনা হয় না।
হে পুকুরের ভাগ্যবান পানি, তুমি যতটুকু পরিষ্কার হয়েছো, সে তো আমারই কারণে। আমি এখানে বসে আমার পা ধুয়ে যাই বলে, তুমি আমার রূপের ছোঁয়ায় আয়নার মত পরিষ্কার হয়েছো। আবার আমি এসে যখন তোমার বুকে গোসল করব, তখন তুমি হবে সবচেয়ে ভাগ্যবান ও মূল্যবান পানি। যে পানিতে আমি গোসল করব, সে পানি তো শুধু পানিই থাকবে না; তা হবে রূপধোয়া পানি, যে পানি ব্যবহার করে রাজ্যের মেয়েরা রূপসী হতে পারবে। বাহ, কী চমৎকার ভাগ্য তোমার! ওরা খুব কষ্ট পেল অহংকারী রাজকন্যার এসব কথা শুনে।
রাজকন্যার বিয়ের বয়স হয়েছে। আশপাশের সব রাজ্য থেকে রাজকন্যার বিয়ের প্রস্তাব আসছে। রাজকন্যার রূপের কথা শুনে রাজপুত্ররা পাগলপারা। কিন্তু রাজকন্যার অহংকারের কথাটাও চলে যায় রাজপুত্রদের কাছে। আর এতেই মুখ ফিরিয়ে নেয় তারা। রাজদরবারের জ্যোতিষীরা রাজকন্যার রূপের অহংকারের কথা শুনে বিয়ের ব্যাপারে পাত্রকে বলে-
রূপ নিয়ে অহংকার যার,
কপালপোড়া ভাগ্য তার।
রূপের সাথে না থাকলে গুণ,
সেই রূপে রাজ্য খুন।
রাজকন্যার অসম্ভব অহংকারের কথা শুনে আর কোনো রাজপুত্রই তাকে বিয়ে করতে আগ্রহ করল না। থেমে গেল বিয়ের কথাবার্তা। কিছুদিন পর। দূরের এক রাজ্যের রাজপুত্র রাজকন্যার অহংকারের কথা জেনেও বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো। সবাই অবাক হয়ে বলে, এ কেমন রাজপুত্র! সব জেনে-শুনেও বিয়ের প্রস্তাব পাঠাল ?
রাজকন্যা এই আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে মনের কথা বলার জন্য ছুটে গেল বাগানে। বাগানে গিয়েই সে থমকে দাঁড়াল। একী! বাগানের এই অবস্থা কেন! ফুল কই? ফল কই? পাখি কই? ফুলের গাছগুলো সব শুকনো কাঠির মত দাঁড়িয়ে আছে। গাছের ফলগুলো শুকিয়ে ঝরে পড়ে আছে মাটিতে। বাগানে পাখির কিচিরমিচির নেই। রাজকন্যা দৌড়ে গেল পুকুরে। না, একফোঁটা পানিও নেই। পুকুরের তলা ফেটে চৌচির হয়ে আছে। আর মলিন হয়ে আছে শান বাঁধা চকচকে ঘাট। রাজকন্যা দুঃখে কাঁদতে লাগল। সে উদাস মনে বারবার চারদিকে তাকায়। সবখানে দুঃখী দুঃখী একটা ভাব। বাগান যেন এক প্রাণহীন বিবর্ণ বিরান ভূমিতে রূপান্তরিত হয়েছে! রাজকন্যা কষ্ট নিয়ে ফিরে এল প্রাসাদে।
রাজপুত্র এসে গেছে। রাজকন্যা জানালা ফাঁক করে একনজর দেখেই, পছন্দ করে ফেলল রাজপুত্রকে। যেমন সুন্দর রূপ তেমনি সুঠাম দেহ। রাজকন্যা মনে মনে ভালোবেসে ফেলল রাজপুত্রকে। রাজকন্যার মন ভালো হয়ে যায়। মনের আনন্দে রাজকন্যা প্রতিজ্ঞা করে বলে ফেলল, যদি বিয়ে করতে হয়, তবে এই রাজপুত্রকেই করব- অন্য কাউকে নয়।
রাজপুত্র শুধু সুন্দর রূপ আর সুঠাম দেহেরই অধিকারী নয়, সে অনেক বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমানও বটে।
রাজপুত্র বললো, রাজকন্যাকে দেখে পছন্দ হয়েছে আমার। শুনেছি, রাজকন্যার জন্য আছে সুন্দর ফুল বাগান আর শান বাঁধানো পুকুর। আমি দেখতে চাই রাজকন্যার প্রিয় বাগান ও পুকুর। রাজপুত্রের মুখে এ কথা শুনে রাজকন্যার বুকটা ধ্বক করে উঠল। সবার মুখ শুকিয়ে কাঠ। লজ্জায় পড়ে গেল সবাই। কীভাবে দেখাবে এই মৃত বাগান আর শুকিয়ে যাওয়া পুকুর? কী ভাববে রাজপুত্র? কিন্তু না দেখিয়েও তো উপায় নেই। অবশেষে রাজপুত্র ঘুরে ঘুরে বাগান আর পুকুর দেখতে গেলো। চারদিকে শুধু কষ্টের ছাপ। রাজপুত্র অনুভব করছে, রাজকন্যার অহংকারের নির্মম যন্ত্রণা সইতে না পেরে, ফুল-ফল-পাখি-হাঁস-মাছ-পানি অভিমানে মাটির নিচে লুকিয়ে আছে।
রাজপুত্র ফিরে এলো প্রাসাদে। বিয়ের তারিখ নিয়ে কথা উঠতেই রাজপুত্র বললো রাজকন্যার বাগানে যেদিন ফুল ফুটবে, ফল ধরবে, পাখিরা মনের সুখে গান ধরবে, আর পুকুরে হাঁস ও মাছেরা খেলা করবে, ঠিক সেদিনই হবে আমাদের বিয়ে। এখন উপায়? রাজকন্যা তো জানে-ই না, কেন ফুল ঝরে গেছে, ফল শুকিয়ে গেছে, পাখিরা গাইছে না, পুকুরে পানি নেই, কেন?
অনেক চিন্তা করার পর, একসময় রাজকন্যা পুরো বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারল। তখন রাজকন্যার ভেতরে শুরু হলো আবেগের সঙ্গে বিবেকের যুদ্ধ। মন্দের সঙ্গে ভালোর যুদ্ধ। অহংকারের সঙ্গে ভালোবাসার যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত ভালোবাসার কাছে সমস্ত অহংকার চূর্ণ হয়ে গেল। রাজকন্যার ভেতরে সত্য-সুন্দর আর ভালবাসার সুর বেজে উঠল।
রাজকন্যা এক দৌড়ে চলে গেল বাগানে। সেখানে সে হাঁটু গেড়ে বসে, শুকনো ফুলগাছ ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে কাকুতি-মিনতি করে বলল, দেখো, অহংকার আমাকে অমানুষ করে রেখেছিল। আমি অনেক ভুল করেছি, তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমি অনুতপ্ত। আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। তোমরা সবাই আমাকে ক্ষমা করে দাও। তাঁর চোখভরা পানি।
রাজকন্যা কাঁদতে কাঁদতে মাথা তুলে দেখে ফুলে-ফলে ভরে গেছে গাছ। ফুলেরা হালকা হাওয়ায় মাথা নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছে রাজকন্যাকে। আনন্দে মুখ চিকচিক করে উঠল রাজকন্যার। তারপর সে চলে গেল পুকুরে। সেখানে গিয়ে দাঁড়াবার সাথে সাথে পুকুর ভরে গেল টলটলে পানিতে। হাঁস আর মাছেরা আনন্দে লুটোপুটি খাচ্ছে নিরহংকার রাজকন্যাকে দেখে। দেখতে দেখতে সবকিছু প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠেছে আগের মত। আনন্দে টগবগ করছেন রাজকন্যা।
মহাসমারোহে বিয়ে হয়ে গেল রাজকন্যার। বাগানে গিয়ে রাজপুত্র ফুল ছিঁড়ে রাজকন্যার খোঁপায় পরিয়ে দিয়ে বলল, এখন তোমাকে আরও সুন্দর লাগছে। রাজকন্যাও খুশি হয়ে রাজপুত্রকে বলল, আরও সুন্দর দেখতে হলে, চলো যাই পুকুর ঘাটে। অহংকার ঝেড়ে ফেলে দিয়ে, একবুক ভালবাসা নিয়ে, রাজকন্যা চলে গেল তাঁর শ্বশুরবাড়ি। বেজায় সুখে আছে তাঁরা।
আরও মজার গল্প জানুন
আরও মজার গল্প জানুন